জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বিএনপির জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া জামায়াতকে ‘ট্রামকার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছে কতিপয় রাজনৈতিক দল। এর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন বিশিষ্ট নাগরিকরাও। ফলে এই ঐক্য তৎপরতা খুব সহজেই আলোর মুখ দেখছে না।
বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি, শর্ত দিয়ে কোনো ঐক্য হয় না। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নির্বাচনী জোট, কোনো আদর্শিক জোট নয়। তাছাড়া জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন খালেদা জিয়া। এখানে জামায়াতকে জড়ানো হচ্ছে নির্বাচনের মাঠে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে, আর কিছু নয়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতকে জোটে রাখলে লাভ ক্ষতির হিসেব মিলাচ্ছে বিএনপি। অপরদিকে জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্য গঠনে বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এ ব্যাপারে তেমন সাড়া মিলছে না। বিশেষ করে বামদলগুলো ‘কঠিন’ শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। সবাই জামায়াতকে ব্যবহার করছে ট্রামকার্ড হিসেবে।
এখানে জামায়াত কোনো সমস্যা নয়, কারণ এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে জামায়াত যুক্ত না - এমনটাও দাবি করছে বিএনপি।
দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল(অব.) রুহুল আলম চৌধুরী মঙ্গলবার (২ আগস্ট) দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘শর্ত দিয়ে কোনো ঐক্য হয় না। জামায়াত জোটে থাকবে কিনা এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। জামায়াতকে জোটে রাখা যাবে না এই নিয়েও মতামত আছে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এখানে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী জোটে। জামায়াতকে জড়িয়ে ইস্যু বানালে চলবে না। জঙ্গি সংকট মোকাবিলায় ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই আর কোনো ঝামেলা থাকছে না। তা না করে জামায়াতকে ট্রামকার্ড বানানো হয়েছে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য।’
জাতীয় ঐক্য গঠনে শর্তহীনভাবে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ার কথাও স্বীকার করেন বিএনপির এই নেতা।
বিএনপির জাতীয় ঐক্যের সাড়ার প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেওয়ার পক্ষে। আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এজন্য একটু সময় লাগছে। আমরা কোনো লীগ বলছি না। এখানে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলো থাকতে পারে। কেননা শুধু পুলিশ বা প্রশাসন দিয়ে উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ যদি না সাড়া দেয় আমরা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলো সাড়া দিচ্ছে। তারা নিজেরাও জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে।’
গত ২০ জুলাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মঞ্জুরুল আহসান খান ও হায়দার আকবর খান রনোর সঙ্গে বৈঠক করেন। আগের দিন ডা. জাফরুল্লাহ বৈঠক করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। ১৯ জুলাই বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামানের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
এদিকে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার ছেলে মাহি বি. চৌধুরী দুজনেই এখন যুক্তরাষ্ট্রে। ৯ আগস্ট তাদের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনও এ মুহূর্তে বিদেশে রয়েছেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক মতবিনিমিয় অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার (০২ আগস্ট) কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জানান, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) মাগরিবের নামাজের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এদেশের ঐক্য হবে মানুষের ঐক্য। যারা মানুষের নেতা তারাই দেশকে চালাবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৪ তারিখ মাগরিবের নামাজের পর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে নয়, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবো। তিনি প্রকৃত বিরোধী দলের নেত্রী। তার সঙ্গে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে যাবো।’
জামায়াতকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য হতে পারে না জানিয়ে তিনি বিএনপিকে পরামর্শ দেন, ‘নজর বদলান, চলা বদলান, ভুলত্রুটি স্বীকার করুন, আর হাওয়া ভবন হবে না; এর গ্যারান্টি দিন। এই অপমানজনক বেঁচে থাকার চেয়ে মাথা উচু করে বেঁচে থাকবো।’
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ একই অনুষ্ঠানে বলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দল বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দল ওই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারে। বর্তমানে দেশের বিরোধী দল বিএনপি। তিনি (খালেদা জিয়া) সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ২০ দলের মধ্যে অন্ততপক্ষে এই দলটিকে (জামায়াত) আর ওইভাবে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, ওই দলটির লায়াবিলিটি (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার দায়) বহন করতে চান না তিনি। সুতরাং এই দিক থেকে দেখলে প্রতিবন্ধকতা নেই।
তিনি আরো বলেন, ‘অন্যদিক থেকে বলব, জামায়াতে বর্তমানে যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদের অধিকাংশের জন্ম একাত্তর সালের পরে। এরাও দেশ ও জাতির অংশ। সুতরাং তাদেরও একটা চিন্তা-ভাবনা থাকা দরকার। জাতীয় ঐক্য যদি তাদের কারণে ব্যর্থ হয়, সেটা তারাই বা চাইবেন কেন? সুতরাং এটা নিয়ে ঝগড়া-ঝাটির কোনো কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না।’
২০ দলীয় জোট শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী ছিল, এখনো আছে।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কবি আল মুজাহিদী বলেন, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বলে তারা এখনো স্বীকার করেনি। তারাই জঙ্গিবাদের উস্কানি দিচ্ছেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদকে কার্ড হিসেবে ব্যবহার করছে, ঠিক যেভাবে জামায়াতের কার্ডও ব্যবহার করছে তারা। তাদেরকে নিষিদ্ধ করে দিলেই তো হয়ে যায়, ঝামেলা চুকে যায়।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর গত ৩ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া।
বিএনপির নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। পর্যায়ক্রমে তা ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
উৎসঃ দ্য রিপোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন