আজ (২৭ আগষ্ট) তুরস্কের মহিলা পুলিশদের জন্য কর্মস্থলে হিজাব পরার বৈধতা সম্বলিত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তুরস্ক সরকার। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তুরস্কের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে এরদোয়ান সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া’র অংশ হিসেবে আজ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের মিডিয়াগুলো। এই গেজেট প্রকাশের ফলে পুলিশ সেক্টরে কর্মরত নারীদের জন্য হিজাব পরে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে সরকারী বাধা দূরীভুত হলো।
এ সংক্রান্ত জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছে যে, “মহিলা পুলিশের সদস্যরা তাদের পুলিশি ড্রেসের রংয়ের সাথে মিলিয়ে মুখ খোলা রেখে হেডস্কার্ফ বা হিজাব পরিধান করতে পারবে”। উল্লেখ্য, শতকরা নিরান্নব্বই ভাগ মুসলমান অধ্যূষিত তুরস্কে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে নারীদের জন্য বোরকা ও হেডস্কার্ফ পরিধানের নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।
এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সর্বপ্রথম ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারীতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হিজাব পরে ক্লাশ ও পরীক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে জাতীয় সংসদে এক বিল পাশ করা হয়। বিলটি ৫১৮ আসন বিশিষ্ট সংসদে ৪১১-১০৩ ভোটে পাশ হলে তুরস্কের ইসলাম প্রিয় নারীদের জন্য এক নব যুগের সুচনা হয়। তারপর ২০১৩ সালে সরকারী অফিস আদালতে হিজাব পরে কাজ করা ও পাবলিক সেক্টরে হিজাব পরে চলাফেরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আরেকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তুরস্ক সরকার।
গত ১৫ জুলাই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর গৃহীত সেনা সংস্কার আইনের আওতায় সেনাবাহীনির অফিসারদের স্ত্রীদের হিজাব পরে জনসাধারণের সামনে চলাফেরার নিষেধাজ্ঞাও রহিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ, আজ মহিলা পুলিশদের হিজাব পরে ডিউটি পালনের অনুমতি প্রদান সম্বলিত আদেশ জারির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পথ আরকেটু উন্মুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৯২৩ সাল থেকে তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের উদ্যোগে ইউরোপীয় করণের নামে তুরস্কের মাটি থেকে ইসলাম নির্মুলের সর্বাত্মক প্রক্রিয়া শুরু হলেও তখনো পর্যন্ত সংবিধানে ‘ইসলাম’ই রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল ছিল। তারপর ১৯২৮ সালে 'ইসলাম'কে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বাদ দেয়া হলেও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতাকে তখনো স্থলাভিষিক্ত করা হয়নি। ১৯৩৭ সালে সংবিধানের এক সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে ধর্মীয় পোশাক পরে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের ক্ষেত্রে কোন আইনী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি এবং পুরুষদের ‘তুরবান’ বা বিশেষ পাগড়ি পরার ক্ষেত্রেও কোন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় হিজাব, বোরকা ও পাগড়ী পরে চলাফেরা করা, চাকুরি করাসহ সবক্ষেত্রে বিচরণের ক্ষেত্রে নানা বিড়ম্বনা ও অত্যাচারের শিকার হতে থাকেন ছয়শত বছরের অধিককাল স্থায়ী হওয়া উসমানী সালতানাতের রাজধানী তুরস্কের ধর্মপ্রাণ জনগণ।
শত বিড়ম্বনার পরেও ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের দিকে বোরকা পরিহিত ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ১৯৮৪ সালে বোরকা পরে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রী ও শিক্ষিকারা, অফিস-আদালত, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সকলক্ষেত্রে হিজাব পরিহিত নারীরা নানা বঞ্চনা, নির্যাতন ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিলেন। এমনকি ১৯৯৯ সালে শুধুমাত্র হিজাব পরিধানের অভিযোগে মেরভে কাভাকচি নামে একজন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করে দিয়েছিল দেশটির তখনকার জাতীয় সংসদ। ২০০২ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন একে পার্টি সরকার গঠন করলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে দ্রুত গতিতে। যার ধারাবাহিকতায় আজ পুলিশ সেক্টরেও নারীদের জন্য হিজাব পরার অনুমতি প্রদান করা হলো।
সুত্র: উইকিপেডিয়া ও হাবেরলারডটকম.তেরে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন