বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ ক্ষমতাসীনদের ‘জঙ্গি-জঙ্গি’ শোরগোলের মধ্যেও দেশপ্রেমিকদের ভূমিকায় কোনো এদিক-সেদিক হয়নি। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে চলেছেন। তবে পার্থক্য হলো, ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘নির্বাচিত’ সরকারের পুলিশি দমন-নির্যাতনের কারণে কারো পক্ষেই পল্টন ধরনের ময়দানে, রাজপথে বা প্রকাশ্য কোনো স্থানে সভা-সমাবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। বায়তুল মোকাররম চত্বর তো অনেক আগেই নিষিদ্ধ হয়েছে। এর ফলে জমে উঠেছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। সেদিন ফেসবুকেই দেখলাম, একজন লিখেছেন, সারাদেশ বন্যায় ভেসে গেলেও মন্ত্রী-মিনিস্টার ও ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতাদের কাউকে ‘গামবুট’ পরে পানির মধ্যে তত্পরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে না যেমনটি এরশাদের আমলে দেখা যেতো। সরকারের বদৌলতে এমনকি সেনাবাহিনীকেও বন্যাদুর্গত কোনো এলাকায় দেখতে পাচ্ছে না মানুষ। কথাটা অল্প হলেও এর মধ্য দিয়ে আসলে অনেক কথাই বলেছেন ওই লেখক। তার কথার প্রতিক্রিয়ায় অন্যরা যা লিখেছেন, তার কোনো একটি বক্তব্যও ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে তত্পরতা চালাতে না দেয়ার কারণে।কথা ওঠার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘উজান’ তথা ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে বিগত মাস দেড়েকের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন দৈনিক ও গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, গাইবান্ধা, বগুড়া ও কুড়িগ্রামসহ বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে নদ-নদীর পানি শুধু বিপদসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে না, তীরের বিরামহীন ভাঙনে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। রান্নাবান্না করে খাওয়া দূরে থাকুক তারা এমনকি বাড়িতেও থাকতে পারছে না। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পাশাপাশি ধলেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা ও তিস্তাসহ সব নদ-নদীতে পানি শুধু বাড়ছেই। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টসহ কোনো কোনো এলাকায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বেড়েছে। কোথাও কোথাও বিপদ সীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রাজশাহীর খবর এসেছে বিশেষ গুরুত্বেও সঙ্গে। কারণ, গত ১ জুলাই রাজশাহীতে পদ্মা নদীর উচ্চতা ছিল ১১ দশমিক ৯৩ মিটার। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই এই উচ্চতা ১৭ মিটারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে পদ্মার নির্ধারিত বিপদ সীমা হচ্ছে ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। সে হিসাবে দু’দিন আগেও পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপদ সীমার মাত্র দেড় মিটার নিচ দিয়ে। বড় কথা, কিছুদিন ধরে পানি যে হারে বাড়ছে তার ফলে যে কোনো সময় বিপদ সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সত্যিই তেমনটি ঘটলে রাজশাহী মহানগরীকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পদ্মার এবং বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাও। টাঙ্গাইলের অবস্থাও ভয়াবহ। সেখানে খুব কম গ্রাম রয়েছে যেগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছে। একই অবস্থা চলছে মাদারিপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলাতেও। আড়িয়াল খাঁ নদ এরই মধ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ফলে বহু কিলোমিটার জুড়ে তীর তো ভেঙে পড়ছেই, আশপাশের সকল গ্রামও তলিয়ে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় ভেঙে গেছে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দেয়া বালুর বাঁধ, বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা কৃত্রিম সব বাঁধও প্রবল বন্যায় ভেসে গেছে। পাল্লা দিয়ে বিপদ বেড়ে চলেছে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া লাখ লাখ মানুষের। সরকারের দিক থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে পারছে না তার। বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে উঁচু কোনো স্থান বা স্থাপনাও নেই, যেখানে গিয়ে বিপন্ন মানুষেরা আশ্রয় নিতে পারে। ফলে সাপসহ হিং¯্র প্রাণীর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পানির মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা চলছে খাদ্য ও সুপেয় পানির। কারণ বন্যায় চুলো জ্বালিয়ে রান্নাবানা করা একেবারেই সম্ভব নয়। তার ওপর রয়েছে চাল-ডালসহ খাদ্য সামগ্রীর তীব্র সঙ্কট। মুড়ি আর চিড়ার মতো শুকনো খাবারও পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও পাওয়া গেলেও কেনার মতো সাধ্য নেই প্রায় কোনো মানুষেরই। তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য না পাওয়ায় চিড়া-মুড়ি ও ঝোলা গুড়ের মতো সামান্য কিছু খাবার খেয়ে কোনো রকমে দিন পার করছে বন্যাকবলিতরা। ওদিকে রয়েছে নিরাপদ পানীয় পানির তীব্র অভাব। কুয়া, নলকূপ ও পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ পানি পাওয়া ও পান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বন্যার পানিই পান করতে হচ্ছে, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ডায়ারিয়া ও আমাশয়ের মতো মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী বিভিন্ন্ রোগ। এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। তাদের অনেকে মারাও যাচ্ছে। কারণ, হাজার বিপদেও কোনো চিকিত্সা পাচ্ছে না তারা। হাসপাতাল দূরের কথা, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। বহু লাশের দাফনও করা যাচ্ছে না। লাশগুলোকে সোজা বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের অনেক মর্মান্তিক ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে দেশের পত্রপত্রিকায়, দেখানো হচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশনে। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও সরকারকে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে বা তত্পর হতে দেখা যাচ্ছে না।
আওয়ামী এমপি সাহেবদের তো বটেই, ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদের ‘নির্বাচিত’ জনপ্রতিনিধিদেরও কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ দেশের অন্তত ২৫/৩০টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো পানির নিচে রয়েছে। তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন অনেক এলাকাও। লাখ লাখ বিপন্ন মানুষ অপেক্ষায় আছে সামান্য কিছু ত্রাণ পাওয়ার আশায়। কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। তাদের জীবন আসলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও সরকারের দিক থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়া বা ভূমিকা পালন করা হয়নি। তেমন সদিচ্ছা ক্ষমতাসীনদের আদৌ রয়েছে কি না সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরিবর্তে দেশপ্রেমিকরা জরুরিভাবে বন্যাপীড়িতদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, এখন দরকার খাদসামাগ্রী পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি বন্যাদুর্গতদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা, যাতে তারা কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। যাতে আর কোনো শিশু-কিশোর বা নারী-পুরুষের অসহায় মৃত্যু না ঘটে। বন্যাপরবর্তী চাষাবাদের জন্য সার-বীজসহ কৃষি সামগ্রীর ব্যবস্থা করারও তাগিদ দিয়েছেন দেশপ্রেমিকরা। কারণ, বন্যায় প্রায় সব ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। এমন খবরও প্রকাশিত হচ্ছে যে, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সবজি বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবজির সব ক্ষেতই বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং সব মিলিয়েই সরকারকে কৃষিখাতে বেশি সচেষ্ট হতে হবে। সার-বীজসহ কৃষি সামগ্রীর পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাও সরকারকেই করতে হবে। না হলে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি আবারও ১৯৭৪ সালের মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে যখন দুর্ভিক্ষ ছোবল মেরেছিল এবং হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। যতো নিষ্ঠুরতাই ‘ভর’ করে থাকুক না কেন, ক্ষমতাসীনরা সম্ভবত সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে চাইবেন না।
প্রসঙ্গক্রমে অন্য দু-একটি বিষয়ও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। এরকম একটি বিষয় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, বন্যার এই বিপর্যয় কেবলই প্রকৃতির কারণে ঘটেছে নাকি এর পেছনে ‘উজানে’ অবস্থিত বন্ধুরাষ্ট্রেরও ‘অবদান’ রয়েছে সে সম্পর্কে অবশ্যই ভেবে দেখা এবং জনগণকে অবহিত করার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক পন্থায় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কারণ, ‘ভাটির দেশ’ বলে প্রতি বছর বন্যার পানিতে বাংলাদেশকে শুধু তলিয়ে যেতে হবে এবং ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের কারণে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ পানিবঞ্চিত থাকবেÑ এমন অবস্থা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। বিশেষ করে পদ্মার উজানে ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি সম্পর্কে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান জানা গেছে নেপালের একজন বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. শাস্ত্রদত্ত পন্থর কাছ থেকে। দেশটির টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১১ লাখ বিলিয়ন টাকা। পরবর্তী বছলগুলোতে এই ক্ষতির পরিমাণ কেবল বেড়েছেই।এখনো বেড়ে চলেছে। ড. শাস্ত্রদত্ত পন্থ জানিয়েছেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মহানন্দা, গড়াল ও মধুমতি নদীর পানির স্তর ১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে, বাংলাদেশ হারিয়েছে ৬৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে কৃষিরও। বাঁধ চালু হওয়ার আগের পরিমাণে পানি পাওয়া গেলে বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন ৩৬ লাখ টন বেশি হতো। ভারত যে চুক্তি অনুযায়ী পানির হিস্যা দিচ্ছে না তারও উল্লেখ করেছেন নেপালের ওই পানি বিশেষজ্ঞ। আগে গঙ্গার পানিপ্রবাহ ছিল ৬৯ হাজার ৭০০ কিউসেক, ১৯৯৩ সালে ভারত পানি ছেড়েছে মাত্র ১০ হাজার কিউসেক।
পানি চুরি এবং বাংলাদেশের ভূমি দখলসহ আরো অনেক বিষয়েই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন ড. শাস্ত্রদত্ত পন্থ। তিনি এ কথাও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও নেপালসহ সব প্রতিবেশীর ওপরই ভারত আধিপত্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে।বস্তুত নেপালের এই পানি বিশেষজ্ঞ কোনো বিষয়েই সামান্য বাড়িয়ে বলেননি। ইতিহাসও তিনি সঠিকভাবেই তুলে ধরেছেন। কারণ, ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারত চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে এবং নিয়েছে শুরু থেকেই। এমনকি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আবারও সুযোগ নিয়েছিল ভারত। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর ভারত ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছিল। কিন্তু স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পর, ১৯৯৭ সালের মার্চেই স্থাপিত হয়েছিল সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ড। বাংলাদেশের প্রাপ্য যেখানে ছিল ৩৫ হাজার কিউসেক, সেখানে ২৭ মার্চ ভারত দিয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক। বাংলাদেশ গড়ে ২১ হাজার কিউসেকের বেশি পানি পায়নি। চুক্তিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখা হয়নি, যার পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছে ভারত। একই চুক্তির আড়াল নিয়ে ভারত এখনো পর্যন্ত শুকনো মওসুমে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করছে, কখনো আবার বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে ছাড়ছে। হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে ১৫টি পিলারের মধ্যে ১১টিই নদীর অনেক বাইরে চলে গেছে। অর্থাত এককালের প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। এবারের বর্ষা মওসুমে সে একই পদ্মার ভাঙন থেকে রাজশাহীকে রক্ষার চেষ্টা চালাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে সরকার। মাত্র ক’দিন আগে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, লোক দেখানো তত্পরতা চালাতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ করার ব্যাপারেও দৌড়ঝাঁপ যথেষ্টই করা হচ্ছে। এ ধরনের তত্পরতা সম্পর্কে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজশাহীতে পদ্মার ভাঙন রোধের উদ্দেশ্যে অসময়ে তড়িঘড়ি করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
প্রতি বছরের মতো এবারও দেড় কোটি টাকার সিসি ব্লক স্থাপন করেছিল সরকারের এ সংস্থাটি। কিন্তু পানির প্রবল স্রোতে ব্লকগুলো ভেসে গেছে। ভেসে যে যাবে তা জানা থাকা সত্ত্বেও এমন একটি পদক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। কিন্তু জিজ্ঞাসার সদুত্তর দেয়ার পরিবর্তে পাউবো আবারও টাকা অপচয়ের পুরনো পন্থাতেই পা বাড়িয়েছে। সিসি ব্লকের স্থলে পদ্মার তীর ধরে ফেলা হচ্ছে শত শত বালির বস্তা। তথ্যাভিজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সিনথেটিক বস্তায় ভরে বালি ফেলার মাধ্যমে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটাও ব্যর্থ হয়ে যাবে। ফলে পদ্মার ভাঙন ঠেকানো যাবে না এবং বিশেষ করে তীরবর্তী মানুষের বিপদ অনেক বেড়ে যাবে। প্রকাশিত রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, সিসি ব্লকগুলো যদি সময় থাকতে অর্থাত বৃষ্টি ও বর্ষা শুরু হওয়ার আগে স্থাপন করা হতো এবং সেগুলোর ভেতরে ঢোকানো সিমেন্ট ও অন্যান্য উপাদানকে যদি জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেয়া হতো তাহলেও হয়তো ব্লকগুলো এত তাড়াতাড়ি ভেসে যেতো না। অন্যদিকে এমন এক সময়ে সিসি ব্লকগুলো বসানো হয়েছে যার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি ও বর্ষা। ফলে ভিজে যাওয়া কাঁচা মাটিতে ব্লকগুলো ঠিক মতো বসতে পারেনি। পাশাপাশি ছিল জমাট না বাঁধার বিষয়টি। তাড়াহুড়ো করে কোনোভাবে তৈরি করায় এবং পানি হাতড়ে দায়সারাভাবে স্থাপন করায় জমাট তো বাঁধেইনি, ব্লকগুলোকে সঠিকস্থানে বসানোও সম্ভব হয়নি। এ জন্যই সামান্য স্রোতেই ভেসে গেছে সিসি ব্লকগুলো। এর ফলে বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ শ্রীরামপুর পয়েন্টে পদ্মার ভাঙন মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এমন এক কঠিন সময়ে পাউবো বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের পদক্ষেপ নিয়েছে, যাকে প্রকাশ্যেই অর্থ লোপাট করার ফন্দী ও কূটকৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর কারণ শুধু প্রশ্নসাপেক্ষ নয়, তথ্যাভিজ্ঞদের মতে সহজবোধ্যও।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে সিসি ব্লক দিয়ে শুরু করে বালির বস্তা ফেলে শেষ করার কারণে ভাঙন ঠেকানো তো সম্ভব হচ্ছেই না, মাঝখান দিয়ে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে শত শত এমনকি হাজার কোটি টাকাও। এভাবে পুরো টাকাই আসলে গচ্চা যাচ্ছে। প্রকৃত রহস্যও নাকি এখানেই রয়েছে। বলা হচ্ছে এবং অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, সিসি ব্লক এবং বালির বস্তা ফেলার কাজ বা কন্ট্রাক্ট সব সময় ক্ষমতাসীন দলের বিশেষ কিছু লোকজনই পেয়ে থাকে। তাড়াহুড়োর সুযোগ নিয়ে একদিকে তারা যেনতেনভাবে ব্লক তৈরি করে, অন্যদিকে বালির বস্তার ক্ষেত্রেও চাতুরি ও ফাঁকিবাজির আশ্রয় নেয়। প্রবল বন্যার কারণে ব্লক ও বস্তার কোনোটিরই সঠিক হিসাব নেয়া সম্ভব হয় না। বড় কথা, হিসাব যারা নেবেন, পাউবো’র সেসব কর্মকর্তাকে আগেই হাত করে নেয় ঠিকাদাররা। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হওয়ায় এবং রাজধানীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় কোনো ঠিকাদারকেই কখনো, কোনোবারই জবাবদিহি করতে হয় না। কোনো ঠিকাদারকে কখনো শাস্তির মুখেও পড়তে হয় না। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে প্রতি বছর সিসি ব্লক ও বালির বস্তা ফেলার ব্যাপারটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে খবরটিকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু বন্যায় যখন সারাদেশ ভেসে যাচ্ছে এবং কোথাও যখন মন্ত্রী-মিনিস্টারসহ ক্ষমতাসীনদের তত্পর দেখা যাচ্ছে না, তখন রাজশাহীর এই খবরটুকুর মধ্যে ইঙ্গিত যথেষ্টই রয়েছে। অন্তরালের সত্য হলো, যেখানেই ‘নগদ নারায়ণ’-এর সম্ভাবনা সেখানেই সাধারণত দৌড়ঝাঁপ করেন ক্ষমতাসীনরা।
বন্যাপীড়িতদের সাহায্যে এগিয়ে গেলে যদি ‘নগদ নারায়ণ’ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকতো তাহলে অনেক ওবায়দুল কাদেরকেই টিভি ক্যামেরা নিয়ে হাঁটু পানির মধ্যে লেকচার দিতে দেখা যেতো। স্বৈরশাসক এরশাদের মতো হেলিকপ্টারে চড়েও যেতেন অনেকে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি তেমন নয়। এজন্যই তত্পরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে কেবল রাজশাহীতে, যেখানে রয়েছে ‘নগদ নারায়ণ’ প্রাপ্তির সম্ভাবনা। শেষ করার আগে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি বিষয়ে বলা দরকার। সেটা ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ সম্পর্কিত। দেশপ্রেমিকরা মনে করেন, সরকারের উচিত অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে বাঁধ ও পানির ব্যাপারে মীমাংসা করা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ উত্থাপন করা। সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্যও দেশপ্রেমিক সকল মহল বহু উপলক্ষে তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা শুধু বন্ধুরাষ্ট্রের স্বার্থেই ভূমিকা পালন করে এসেছেন। বন্যাদুর্গতদের ব্যাপারেও সরকারের দিক থেকে এ পর্যন্ত কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।ক্ষমতাসীনরা ব্যস্ত রয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিত্য-নতুন মামলায় ফাঁসিয়ে হেনস্থা করতে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করার এবং মামলা দিয়ে ধাওয়ার মুখে রাখার ব্যাপারেও তারা সমান তালেই এগিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে দেশপ্রেমিকরা মনে করেন, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিবর্তে এখন জরুরিভাবে দরকার বন্যায় বিপন্ন হয়ে পড়াদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া। তাদের মধ্যে খাদসামগ্রী ও সুপেয় পানি পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দরকার নিরাপদ আশ্রয় ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা, যাতে আর কোনো মানুষের অসহায় মৃত্যু না ঘটে। যাতে একজন মানুষকেও অনাহারে কাটাতে না হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন