পলাশ মাহমুদ : ‘আমাদের ছাড়া এই অফিসের কাজ করাতে পারবেন না। চেষ্টা করে দেখেন। ঘুরে-ফিরে আসতে হবে। টাকা দেবেন কাজ হয়ে যাবে। সবকিছু আমরা করে দেবো।’ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার ‘বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’ (বিআরটিএ) এর ঢাকা জেলা সার্কেলের সাভার কার্যালয়ে গিয়ে লাইসেন্স প্রার্থী পরিচয় দিলে এভাবেই বলছিলেন সেখানকার রমিজ নামের এক গ্যাটিজ (দালাল)। বিআরটিএ এর ঢাকা জেলার দুই কার্যালয় সাভার ও ইকুরিয়ায় চলছে ঘুষ, দুর্নীতি, দালালের দৌরাত্ম্য আর জালিয়াতির উৎসব। টাকা ছাড়া এ অফিস দু’টিতে যেন মাছিও ওড়ে না। দুই কার্যালয়ে প্রতি সপ্তাহে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয় বলে জানা গেছে। অবৈধ উপার্জন নির্বিঘœ করতে উপপরিচালক (এডি) মোহাসিন হোসেন নিজ ভায়রাকে দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘গ্যাটিজ’ নামক বিশেষ দালাল সিন্ডিকেট। গ্রাহকদের যেকোনো সেবা পেতে হলে সরকারি ফি ছাড়াও ‘খরচ’ নামের অতিরিক্ত অর্থ দেয়া বাধ্যতামূলক। ‘অটোসিøপ’ নামে পুলিশ কর্মকর্তা আর জনপ্রতিধিদের হাজার হাজার সিল-স্বাক্ষর জাল করার তথ্য পাওয়া গেছে। মোহাসিন হোসেন ঘুষ বাণিজ্য দিয়ে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। অবৈধ অর্থের ভাগ পাওয়ায় বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ের এক পরিচালক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক কর্মচারী অফিস দু’টির কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, দুর্নীতি হয় না তা বলবো না। তবে আমরা দুর্নীতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। মন্ত্রী মহোদয় দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আন্তরিকভাবে দুর্নীতি দমনের চেষ্টা করছেন বলে তিনি জানান। ঢাকা সার্কেলের দুর্নীতি বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল।
সূত্র জানায়, মো. মোহাসিন হোসেন ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে বিআরটিএ’র ঢাকা জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সার্কেলের দু’টি অফিসের মধ্যে তিনি সোম ও বুধবার সাভার অফিসে এবং রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ইকুরিয়া অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। সাভার ও ইকুরিয়া অফিসে ভোগান্তির শিকার একাধিক গ্রাহকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিবেদকের কয়েক দিনের অনুসন্ধানে ঘুষ, দুর্নীতি, পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষর জাল, বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
ঢাকায় ৬ বাড়ি : ঘুষ বাণিজ্যের অর্থ দিয়ে এডি মোহাসিন হোসেন ঢাকা ও গ্রামের বাড়িতে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে শুধু রাজধানীতেই তার ৪টি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে। কয়েক মাস পূর্বে তিনি পান্থপথ সমরিতা হাসপাতালের বিপরীতে ‘ইস্টার্ন পান্থছায়া’ হাউজিং (হোল্ডিং নং-১৫২/২/।-১,২) এর ৪নং ভবনের ১৩ তলায় ১৩০৫ নং ফ্ল্যাট ও ২নং ভবনের ১৪ তলায় ১৪০২ নং ফ্ল্যাট দু’টি কিনেছেন প্রায় ৫ কোটি টাকায়। বর্তমানে তিনি ৪নং ভবনে থাকেন। ওই হাউজিংয়ের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করে। কলাবাগান বশির উদ্দীন রোডে ৫৫/১ নম্বর ভবনের দ্বিতীয়তলায় তার দু’টি (একত্রে) ফ্ল্যাট রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। বাসাটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া। ঢাকা সার্কেলের দায়িত্ব নেয়ার পর সাভারের ব্যাংক কলোনিতে স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে জায়গা ও ভবনসহ একটি বাড়ি এবং আশুলিয়ায় তার ভায়রা জলিলের বাড়ির পাশে আরেকটি বাড়ি কিনেছেন বলে সাভার অফিসের একটি সূত্র নিশ্চিত করে। বাড়ি দু’টির মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা বলে ওই সূত্র জানায়। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে আরো একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানিয়েছে গ্যাটিজ টিমের এক সদস্য। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়ও তিনি একাধিক বাড়ি ও কয়েক একর জমিসহ বিপুল সম্পত্তি বানিয়েছেন বলে তার ভায়রা জলিলের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে মোহাসিন হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি, বশির উদ্দীন রোড ও পান্থপথের ফ্ল্যাট কেনার কথা স্বীকার করেন। তবে সাভার ও আশুলিয়ার বাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি আছে কি না সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই। আপনার কাছে তথ্য থাকলে আমাকে জমির দলিল দেখান। দলিল না থাকলে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলবো না।’
ঘুষ বাণিজ্য : বিআরটিএ ঢাকা সার্কেলের ইকুরিয়া ও সাভার অফিস থেকে যেকোনো কাজ করাতে গেলে ‘গ্যাটিজ’ টিমের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে সরকারি ফি ১৮শ’ ৩৮ টাকা হলেও নেয়া হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে সাভার থেকে প্রায় ৩শ’ ও ইকুরিয়া থেকে প্রায় ৪শ’ ৫০টি লাইসেন্স দেয়া হয়। মোহাসিন হোসেনের দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত সাভারে প্রায় ৭ হাজার আর ইকুরিয়ায় প্রায় ১০ হাজার পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। যা থেকে সপ্তাহে অতিরিক্তি আয় প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা। লার্নার কার্ডের সরকারি খরচ ৫শ’ ১৮ টাকা। এখানে নেয়া হয় ২ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে সাভার ও ইকুরিয়া থেকে প্রায় ৮শ’ লার্নার কার্ড (ড্রাইভিং) দেয়া হয়। এ খাত থেকে সপ্তাহে আয় প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এ বিষয়ে এডি মোহাসিন হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো টাকা নেই না। অফিসের বাইরে দালালরা কি করে সেটা তাদের ব্যাপার।’
শুধু এ দুই খাত থেকে ঢাকা সার্কেলের অবৈধ আয় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। এ টাকার প্রায় ১৫ শতাংশ গ্যাটিজ টিমের সদস্যরা পায়। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ের এক পরিচালক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠ কর্মচারীকে দিতে হয় বলে বিশ্বস্ত সূত্র জানায়। এ অর্থের বিনিময়ে ওই পরিচালক ঢাকা সার্কেলের সব ফাইলগুলো প্রধান কার্যালয়ে দেখভাল করেন।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে পরিচালক (প্রশাসন) মো. মশিয়ার রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য বা অভিযোগ নেই। অভিযোগ পাওয়া গেছে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জলিল-ছগিরের গ্যাটিজ টিম : জলিল নামে এডি মোহাসিন হোসেনের নিজ ভায়রা ও তার ঘনিষ্ঠ ছগির নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে ‘জলিল-ছগির দালাল সিন্ডিকেট’ পরিচালিত হচ্ছে। সরেজমিন সাভার কার্যালয়ে গেলে ছগিরকে অফিস রেজিস্ট্রার খাতা মেইনটেইন করতে দেখা যায়। লার্নার কার্ড তৈরির কক্ষে সরকারি কম্পিউটারে বসে কাজ করতে দেখা যায় রেফাত নামের আরেক গ্যাটিজকে। ড্রাইভিংয়ের প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষায় শিপন, ছগির ও খালেক নামের তিন গ্যাটিজ পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত বোর্ড থাকলেও বোর্ড সদস্যরা বেশিরভাগ সময়ে দিন শেষে এসে স্বাক্ষর করে চলে যান। গ্যাটিজরা পরীক্ষা নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করে। এ বিষয়ে এডি মোহাসিন হোসেন বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট থাকার কথা। ওনারা কাজে-কামে থাকেন। অন্যরাও অনেক সময় ব্যস্ত থাকেন। এখন কি করার। পরীক্ষাতো নিতে হবে। সেজন্য এরা ওখানে থাকে।’ সাভারে গ্যাটিজদের টাকা এডির হাতে যায় ভায়রা জলিলের হাত দিয়ে। আর ইকুরিয়ায় আবুল হোসেন, আনসার কমান্ডার কাউসার ও রাজধানী টেকনিক্যাল নামে একটি ড্রাইভিং স্কুলের মালিক মঞ্জুর মাধ্যমে এ কাজ হয়। জলিল-ছগিরের গ্যাটিজ টিমে খালেক, জহির, শিপন, লালন, ইবরাহিম, মঞ্জু, আছাদ, মাসুদ, রেজাউল ও অসিমসহ প্রায় ১৫ জনকে সক্রিয় দেখা যায়।
অটোস্লিপ : পুলিশের ভাষায় ভেরিফিকেশন বা তদন্ত। আর বিআরটিএ’র গ্যাটিজ টিমের ভাষায় অটোস্লিপ। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর পুলিশি তদন্ত বাধ্যতামূলক। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকে। কিন্তু ১ হাজার টাকায় পুলিশি তদন্ত তৈরি করে এই গ্যাটিজ টিম। নিয়ম অনুযায়ী চিঠি ইস্যু করা হয়। চিঠি ডাকে না পাঠিয়ে আবেদনকারীর স্বহস্তে দেওয়া হয়েছে বলে রেজিস্ট্রারে উল্লেখ করা হয়। পরে আবেদনকারীর স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার নাম, সিল-স্বাক্ষর জাল করে বানিয়ে ফেলা হয় অটোস্লিপ। আর সিএনজি-অটোরিকশা লাইসেন্সের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানেও অটোস্লিপ করে জাল কাগজপত্র তৈরি করা হয়। বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কপি কাগজে পুলিশ কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষর জ্বাল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সাভারের ৯৬ ও ৯৭নং ভলিউম’র সবগুলো ভেরিফিকেশন নকল বলে সূত্র নিশ্চিত করে। এ বিষয়ে এডি মোহাসিন হোসেনের কাছে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালের অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু কিছু এমন হয়। তবে আমাদেরতো লোকালে গিয়ে যাচাই করার সুযোগ নেই। সন্দেহ হলে আমরা সেগুলো বাদ দিই। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এমন দু’টি অটোস্লিপ বাদ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।’
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের জানা নাই। তবে এটা হলে তো মারাত্মক অপরাধ। সঠিক তথ্য থাকলে আমরাই (পুলিশ) ব্যবস্থা নেব।’ এ বিষয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করারও অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দীকের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি কথা বলতে রাজি নয় বলে জানান তার একান্ত সচিব মতিউল ইসলাম চৌধুরী। পরে সচিরের ইমেইল ঠিকানায় (রহভড়@ৎঃযফ.মড়া.নফ) সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য চাইলেও এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত (দু’দিনে) তিনি কোনো উত্তর দেননি।
Inqilab
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন