তার চোখে তীব্র চাহনি। নীরব ক্ষোভের প্রতিফলন তাতে। তার শরীরী ভাষায় অসহায়ত্ব। মোহাম্মদ করিম নির্বিকারভাবে একটানা সুপারি চিবিয়ে চলেছেন। সেটা যেন দুঃসহ যন্ত্রণা আর ভয়াবহ সময় থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোর একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। টাটকা সেই স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন করিম। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি অবস্থায় একটি শরণার্থী শিবিরে তাঁবুর ভেতর বসে রয়েছেন তিনি। কিন্তু, তার মন তখন সেখানে নেই। আশ্রয় শিবিরে তার চারপাশে বসেছে কথার হাট। তা সত্ত্বেও, অনেকের মাঝে নিঃসঙ্গ তিনি। পাশের নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্ন তাঁবুর বাইরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আশ্রয়প্রাপ্ত অনেকেই। স্বস্তি পেতেই তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। তবে আমার বুঝতে দেরি হলো না, কেন করিম এতো মানুষের ভিড়েও একা। তিনি এখানে নতুন। এই আশ্রয়-শিবিরে তিনি নতুন। অপরিচিত শহর হায়দ্রাবাদ, অপরিচিত ভারত। স্ত্রী, কন্যা, মা ও বোনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এই রূঢ়, নিষ্ঠুর বাস্তবতাও যে নতুন তার কাছে! আল-জাজিরা ব্লগে সাংবাদিক নিধি দত্ত মোহাম্মদ করিমের কাছে তার ভেতরের লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোর কথা জানার চেষ্টা করেছেন। এখানে সেই বিবরণ তুলে ধরা হলো:
করিম বলছিলেন তার বয়স ৩২ বছর। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তার বাড়ি। ৩ দিন আগে হায়দ্রাবাদে এসেই সোজা এই শিবিরে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হায়দ্রাবাদের বালাপুরের এ শিবিরটিকে রোহিঙ্গা অভিবাসীরা চেনেন ‘ক্যাম্প ওয়ান’ নামে। নিজ দেশ মিয়ানমারে তারা প্রতিনিয়ত যে নির্যাতন-নিপীড়ন, নিদারুণ যন্ত্রণা ও বঞ্চনার শিকার হন, তা থেকে মুক্ত হয়ে এখানে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অনেকেই তাদের জীবন নতুন করে শুরু করতে চান।
করিমের ঘটনা বোঝা কঠিন ছিল। রোহিঙ্গা ভাষা, হিন্দি ও ইংরেজীর মিশ্রনে ধীরলয়ে চলছে আমাদের কথোপকথন। তিনি এভাবে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলনমানদের চায় না বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। তারা আমাদের বলে, আমরা মিয়ানমারের নাগরিক নই। তারা বলে, আমরা বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া বা অন্য যে কোন দেশের নাগরিক, তবে মিয়ানমারের নই। তারা বলে, মিয়ানমার ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া উচিত। তারা এসে আমাদের বাড়িঘর, মসজিদে আগুন দেয় এবং তাড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদের ওপর নির্যাতন চালায় ও আমাদের হত্যা করে।
আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করতে পারি না, যেখানে আমাদের কোন শান্তি নেই এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার কোন আশা নেই। সে কারণেই আমরা দেশ থেকে বের হয়ে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিই। করিম বলছিলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ অনেক দীর্ঘ ও বিপজ্জনক। অনেকেই তা করতে ব্যর্থ হয়। যারা বোটে সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করে, প্রায়ই তাদের বোটডুবিতে মৃত্যু হয়, অথবা তাদের আটক করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। সে কারণেই আামি আমার পরিবারের সঙ্গে ভারতে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি শুনেছিলাম, আমাদের মতো মানুষকে স্বাগত জানায় ভারত। আমি জানতাম, এখানে অন্যান্য রোহিঙ্গা মুসলমানরা বসবাস করছেন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আমার কয়েক আত্মীয় এখানে বসবাসের একটি ঠিকানা পেতে সক্ষম হয়েছেন।
আমার মনে হয়েছিল, এখানে এলে, আমাদের পরিবারও নিরাপদ থাকবে। তাই আমি আমার স্ত্রী ও ৯ মাসের কন্যাশিশুকে নিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়লাম। আমরা প্রথম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পৌঁছাই। সেখানে স্থানীয় কয়েকজন আমাদের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকতে সাহায্য করলেন। আমরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছলাম। কিন্তু, ঠিক তখনই সবকিছু আমাদের বিপক্ষে চলে গেলো।
কর্তৃপক্ষ আমার স্ত্রী ও কন্যাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। কোনভাবে আমি পালাতে সক্ষম হই। আমি আদৌ জানি না, তারা কোথায় আছে। মিয়ানমারে আমার মা এবং বোনও আটকা পড়েছে। আমি জানি না আমার পরিবারকে খুঁজে বের করতে এবং প্রত্যেককে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে আমাকে কি করতে হবে।-কাজী আরিফ আহমেদ, মানবজমিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন