আল-ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থার নাম। যারা এই আদর্শের ছায়াতলে নিজেদেরকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করে তারাই মুসলমান। মুসলমান হওয়ার সুযোগ দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের। আবার জাহেলিয়াতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেই মুসলমানিত্ব যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগঠিত জীবনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রুজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আল কুরআন)
হাদিসেও এর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, “তোমরা তিনজন সফরে বের হলেও তোমাদের মধ্যে একজনকে নেতা বানাও।” অনত্র বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি সংগঠন থেকে দূরে সরে গেল সে ব্যক্তি ইসলাম থেকে তার গর্দান সরিয়ে ফেলল।”
সঙ্ঘবদ্ধভাবে যারা ইসলামের সৌন্দর্য প্রচার-প্রসার ও আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় এর প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টার কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে তারাই ইসলামী আদর্শের কর্মী। আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী মানেই আন্দোলনের পক্ষ থেকে ব্যক্তির ওপর আন্দোলনের যে দায়িত্ব অর্পিত হবে তা যথাযথভাবে পালন করবে। কর্মীর সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যের মূলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোথাও যদি দুনিয়ার সম্মান মর্যাদা অর্জিত হয় এতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে মুষড়ে পড়ে যাওয়ারও জো নেই। আবার পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা কাজের চাপে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য বেমালুম ভুলে গেলেও চলবে না। জীবনের প্রকৃত সার্থকতা লাভ করাই হবে একজন আদর্শ কর্মীর অন্যতম কাজ। ইসলামী আদর্শের কর্মীদের কিছু মৌলিক বিষয় সার্বক্ষণিক স্মরণ রাখা জরুরি। আন্দোলনের কর্মীদের মৌলিক বিষয়ে যদি বোঝার বা চিন্তার ঘাটতি থাকে, তা আন্দোলনের প্রকৃত সফলতার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সাময়িক আদর্শের বিজয়ার্জন হলেও আদর্শিক কর্মীদের সঠিক বোধ ও চিন্তার লালনের অভাবে বিজয়ার্জন টেকসই হয়ে ওঠে না। ইসলামী আদর্শের কর্মীদের নিম্নের বিষয়গুলোতে সঠিক চিন্তার লালন জরুরি।
(১) আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনই জীবনের মূল লক্ষ্য
যেকোনো সচেতন ব্যক্তি মাত্রই কোনো কাজ করার আগে সে কাজের ফলাফল কী হতে পারে তা ভেবেচিন্তে কাজ শুরু করেন। যেমন একজন ব্যক্তি তার সন্তানের পড়াশুনার জন্য ভালো স্কুলে ভর্তি করেন, দক্ষ হাউজ টিউটর রাখেন। কারণ তার ছেলে ভালো পড়াশুনা করে দুনিয়ার বাজারে নিজেকে সুদক্ষ করে তুলবে। তেমনি একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় ভালো করার জন্য সব পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ করেন। কারণ ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়ো ভালো করতে চান। ঠিক এমনিভাবে একজন বুদ্ধিমান মুমিন মাত্রই স্থায়ী লাভের চিন্তায় জীবনের সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দুকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে স্থির করেন। ইহজাগতিক অর্জিত সকল যোগ্যতা অর্জনও দ্বীনের কাজে সঁপে দেন। একজন মুসলমান ছাত্র ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্জন করে সেই পেশায় আত্মনিয়োগ করলেও সেই পেশার মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ সাধন করে আল্লাহর রাজি-খুশি অর্জন করাই হবে মূল টার্গেট। তাই একজন মুসলমান দুনিয়ার ভোগ বিলাসের কাছে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে আল্লাহকে ভুলে যাবে তা কখনো হতে পারে না। তাই মুমিন মাত্রই জীবনের প্রতিটি কাজ কত সুন্দর করে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তাঁর সন্তুষ্টির উপযোগী করা যায় সে ব্যাপারে সচেতন ও যতœবান হবেন।
(২) আদর্শের প্রতি অবিচলতা
যেকোনো আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদের সে আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস লালন করতে হয়। বিরোধী পক্ষের শত জুলুম নির্যাতন, অপপ্রচার তাদেরকে তাদের পথ চলা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আদর্শের কর্মীরা যদি সে আদর্শকে কথায় ও কাজে রূপান্তরিত করতে পারে তাহলে স্বল্প সময়ে এর প্রভাব সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আদর্শ হচ্ছে আল ইসলাম, ইসলামের আদর্শের ওপর আমৃত্যু টিকে থাকাই হবে ইসলামী আদর্শের কর্মীদের অন্যতম কাজ। ইসলামবিদ্বেষী চক্রের নানাবিধ ষড়যন্ত্র, অত্যাচার-নিপীড়ন ও বর্তমান সময়ে ইসলামী আদর্শের কর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ যত কঠিন হয় আন্দোলনের জনশক্তির মাঝে তত নতুন নতুন প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম নেয়। নিজেদের ভবিষ্যৎ ও আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বা হতাশ হয়ে পড়ে। তাই এর সঠিক জবাব জনশক্তিদের সামনে স্পষ্ট করার পাশাপাশি বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে সময়ে সময়ে যারা নিজেদের চিন্তার পরিবর্তন করে, সেই দোদুল্যমান আদর্শবাদী কর্মীদের নিয়ে প্রকৃত সফলতা দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমার হয় না। রাসূল (সা:) ও সাহাবীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রাতিরিক্ততা ছিল অবর্ণনীয়, মুনাফিকরা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের জাল পেতে রেখেছিল, পারস্পরিক সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা তাদের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছিল। এরপরও রাসূলের (সা:) সাহাবীরা ইসলামের আদর্শের প্রতি ছিলেন ঠায় অবিচল। কোনো কিছুই (লোভ-লালসা, জুলুম-নির্যাতন) তাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ টলাতে পারেনি। তেমনি ইসলামী আদর্শের কর্মীদের সামনে যত চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান আছে তা চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেই মোকাবেলা করতে হবে।
(৩) আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করা
যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠিত হয় কোনো একটি আদর্শের ওপর। রাষ্ট্রে যে আদর্শের প্রভাব বেশি থাকবে সে আদর্শের ধারকরাই স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। বর্তমান সময়ে জোর করে আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পৃথিবীতে কায়েমের নজির কমে গেছে। কারণ সেই জনপদের মানুষের ভেতর গঠিত রাষ্ট্রের আদর্শের ব্যাপারে যদি প্রশ্ন থাকে, সেই প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক রাষ্ট্র টেকসই হয় না। যার ফলে কালান্তরে সে আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয়ের প্রহর গুনতে হয়। তাই একটি সফল কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সে দেশের মানুষের মাঝে আদর্শের প্রচার প্রসার ঘটাতে হবে। বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত সকল মতাদর্শের ওপর নিজের মতাদর্শকে সেরা আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে এবং তা বাস্তবে রূপ দেয়ার সাধ্যাতীত চেষ্টা করবে। আদর্শের লালনকারীরা জনগণের জন্য কী করতে চায় তার প্রচার করতে হবে। সকল অপপ্রচারের যৌক্তিক জবাবও তাদের দিতে হবে। ইসলামী আদর্শের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটাতে হবে। যেহেতু ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসীরা ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, তাই দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে ইসলামে পক্ষে জনমত গঠনের মাধ্যমে ইসলামের পক্ষে মানুষের অবস্থান তৈরি করা এবং এর মাধ্যমেই চূড়ান্ত টেকসই আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সাধারণত রাষ্ট্রের সবাই আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী নাও হতে পার। কিন্তু সে ব্যক্তি চিন্তা চেতনা যদি আদর্শের পক্ষে তৈরি হয় তাহলেই একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
(৪) জনশক্তির চিন্তার ঐকমত্য
একটি আন্দোলনের সফলতার জন্য সেই আন্দোলনের জনশক্তিদের চিন্তার ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। চিন্তার ঐকমত্য ব্যতীত সম্মিলিত কাজে মতদ্বৈধতা ও মতবিরোধ সৃষ্টি হবে। পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হবে, যা একটি আন্দোলনের স্বপ্নসাধ অঙ্কুরেই নষ্ট করে ফেলে। তাই সংগঠনের মূল ব্যক্তি থেকে শুরু করে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত সংগঠনের চিন্তার ভিত্তির ওপর ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই। যেখানে সবার উদ্দেশ্য একই সুতোয় গাঁথা, স্মরণ রাখতে হবে আন্দোলনকে গতিশীল ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য সবার মতামত ব্যক্ত করার মতো সুযোগ থাকতে হবে। যাতে সবার চিন্তা একই ¯্রােতে প্রবাহিত হয়। মতপ্রকাশ করতে না পারার কারণে যেন ভিন্ন কোন ধারা-উপধারা বা পরিবেশ দূষিত না হয় সে ব্যাপারে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা।
যারা আন্দোলনের পরিচালক তাদেরও স্মরণ রাখতে হবে হাউজে জনশক্তিদের কথা বলার অবারিত সুযোগ থাকতে হবে। উত্থিত বিষয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ পূর্বক সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক ও কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সচেষ্ট হবেন। জোরপূর্বক কোনো সিদ্ধান্ত ময়দানে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো সে বিষয়ে যৌক্তিক বিষয়গুলো হাউজে পুনরায় আলোকপাত করা। যাতে সর্বপর্যায়ে একই চিন্তার নিরিখে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দ্বিধা না থাকে। আন্দোলনের জনশক্তির টপটু-বটম সংগঠনের চিন্তাই আমার চিন্তা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়াকেই চিন্তার ঐকমত্য বলা হয়।
(৫) সাধ্যমাফিক নিজের ওপর অর্পিত কর্তব্য পালন করা
প্রবাদ প্রবচনে প্রচলিত আছে- ‘মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে।’ এ কথা মোটেও ঠিক নয়, কারণ সাধ্যাতীত কাজ কেউ করতে পারে না, মানুষের যা সাধ্য কেবল তাই সে করতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় প্রত্যেক মানুষের যে মেধাশক্তি থাকে মানুষ তার কিয়াদংশও ব্যবহার করে না। যারা চেষ্টা করে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী কর্ম আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কিছু করেছে বলে মনে হলেও মূলত সেই কৃতকাজ মানুষের দ্বারাই সাধ্য। আমরা বিপদ মুসিবতে মুষড়ে পড়ি, কোন কাজে প্রত্যাশিত ফল না পেলে থমকে যাই, হীনমন্যতায় ভোগী, চিন্তার অনৈক্য দেখা দেয়। মনে হয় আমরা বা আমি পারলাম না; যারা ইসলামী আদর্শ লালন করে তারা এমন ধারণা পোষণ করতে পারে না। কারণ প্রত্যেক ঈমানদার মানেই বিশ্বাস করে, “ভালো-মন্দ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে” এটি ঈমানের অংশ। রাসূল (সা:) হাদিস শরিফ থেকে এর চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “তোমরা ঘোড় সাওয়ারকে বেঁধে রেখে আল্লাহর ওপর ভরসা কর।” আরো একটি হাদিসে রাসূল (সা:) নির্দেশ করেছেন, “তোমরা যখন ছাদে ঘুমাবে তখন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আল্লাহর দরবারে ভরসা করবে।” এতে বোঝা যায় একজন মানুষ হিসেবে শক্তি-সামর্থ্যর যতটুকু পারা যায় ততটুকু দায়দায়িত্ব মানুষকে পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ফরমান, “আল্লাহ কারোর ওপর তার সামর্থ্যর অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপান না। প্রত্যেক ব্যক্তি যে নেকি উপার্জন করেছে তার ফল তার নিজেরই জন্য এবং যে গোনাহ সে অর্জন করেছে, তার প্রতিফলও তারই ওপর বর্তাবে। (হে ঈমানদারগণ, তোমরা এভাবে দোয়া চাও:) হে আমাদের রব! ভুল-ভ্রান্তিতে আমরা যেসব গোনাহ করে বসি, তুমি সেগুলোর জন্য পাকড়াও করো না। হে প্রভু! আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না, যা তুমি আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। হে আমাদের প্রতিপালক! যে বোঝা বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। আমাদের প্রতি কোমল হও, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি করুণা করো। তুমি আমাদের অভিভাবক। কাফেরদের মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো। (সূরা বাকারা : ২৮৬)
রাসূল (সা:) যখন তাবুক অভিযানে বের হলেন তিনি তার সাহাবীদের অভিযানে বের হওয়ার জন্য আহবান জানান। কিছু সাহাবী মনের নানা দুর্বলতার (ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা) কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাননি। তারা মানসিকভাবে এমন কষ্টদায়ক সফরে বের হতে চাইছেন না অথচ আল্লাহ তায়ালা তাদের সফর করতে বলেছেন। এতে বোঝা যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্দেশিত হয়েছে তা তার বান্দাদের সাধ্যের মধ্যেই। সাধ্যের মধ্যে থাকার পরও যদি অভিযানে বের হবে না তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কড়াভাবে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আর একটি দলকে উঠাবেন, আর তোমরা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।” (সূরা তওবা : ৩৯) আল্লাহর গোলাম সাধ্যমোতাবেক চেষ্টা না করার কী কারণ থাকতে পারে? সেই কারণকে সামনে উপস্থাপন করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো? যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, অমনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখো, দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে।” (সূরা তওবা : ৩৮) সুতরাং ইসলামী আদর্শের ধারকদের উচিত হবে নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করা এবং বাকি অপারগতার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। নিজেকে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
(৬) বিপদে মুষড়ে না পড়া
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে এমনি বিপদ মুসিবতে ঠেলে দেন না। বরং অনেক পরীক্ষা ঈমানদারদেরকে যাচাই করার জন্য একটি মাধ্যম মাত্র। আল্লাহর পথে চলতে গেলে আল্লাহদ্রোহীদের নানামুখী অপতৎপরতার কারণে বিপদ মুসিবতে পড়তে হয়, যে বিপদগুলো মানুষ সৃষ্টি করে আবার কিছু বিপদ আছে যেখানে মানুষের হাত নেই। এমন বিপদসঙ্কুল অবস্থায় আদর্শিক কর্মীদের কাজ হবে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। বিপদগুলোর ধরনÑ “আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও এবং যখনই কোনো বিপদ আসে বলে, “আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৬৫)
ঈমানদাররা যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে না গিয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে আল্লাহর পথেই তাদের সকল চেষ্টা ও তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাৎহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোনো সন্দেহ পোষণ করেনি। তারপর প্রাণ ও অর্থসম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে। তারাই সত্যবাদী। (সূরা হুজুরাত ১৫) আমরা যারা ইসলামী আদর্শের অনুসারী আমাদের জীবনচলার পথে জাহেলিয়াতের নানামুখী অপঘাতে থমকে দাঁড়াই বোধ করি এই মনে হয় জীবন গেল, এই মনে হয় সর্বস্ব খোয়ালাম! কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে কি চলবে? এসব অপঘাতে যদি আদর্শবাদী দলের কর্মীরা থমকে যায় জীবনের মায়ায় ও দুনিয়ার লোভ-লালসায় জড়িয়ে পড়ে, আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্বের চাইতে দুনিয়ার সাময়িক প্রাপ্তিতে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, হার মেনে নেয় তাহলে তারা কী করে আদর্শের কর্মীরা কী করে জাহেলিয়াতের ওপর ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখে?
(৭) বিজয় আনন্দে অতিমাত্রায় উল্লসিত না হওয়া
ইসলামী আদর্শের অনুসারীরা সমগ্র বিশ্বমানবতাকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণের আহবান জানাবে। সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জমিনে তার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হুকুমাতে ইলাহি বা ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে সবার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত ও রাসূল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানবজীবনের কল্যাণ সাধনের চেষ্টায় ব্রত থাকাই ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের অন্যতম কাজ। এর মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূল লক্ষ্য। আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে যদি চূড়ান্ত বিজয় চলে আসে তখন বিজয় আনন্দে অতিমাত্রায় উল্লসিত হয়ে পড়া ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের জন্য শোভা পায় না। বরং ইসলামী খেলাফতের বিজয়ের পর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। দুনিয়া ও আখেরাতে দায়িত্বের জবাবদিহিতার পেরেশানি বেড়ে যাওয়ায় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে। এ কারণেই হজরত ওমর (রা:)-এর ওপর যখন খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হলো তখন নিজের প্রতি আফসোস করে বলেছিলেন, “হে ওমর! তুমি যদি আজ ওমর না হয়ে সামান্য খড়কুটা হয়ে জন্ম নিতে তাহলে আল্লাহর কঠিন জবাবদিহি থেকে বেঁচে যেতে।” তিনি একইভাবে দায়িত্বানুভূতির পেরেশানি থেকে বলেছিলেন, “ফারাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি অভুক্ত হয়ে মারা যায় এ জন্য আমাকে আল্লাহর দরবারে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।” বিজয় অনেক সময় নিজেদের আত্মভোলা করে ফেলে, অহঙ্কারী করে তোলে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা ও আমানতের সুরক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। যেমন রাসূল (সা:) মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ অহি প্রেরণ করলেন, “যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়। আর (হে নবী!) তুমি (যদি) দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছে, তখন তুমি তোমার রবের হামদসহকারে তাঁর তাসবিহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্য তিনি বড়ই তওবা কবুলকারী (সূরা নাসর)
(৮) প্রকৃত সফলতার মানদন্ড কী?
ইসলামী আদর্শের ঝান্ডাধারীদের প্রকৃত সফলতার মানদন্ড কী? জাগতিক জগতে নেতৃত্ব-কর্তত্ব, যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত-বৈভব সফলতার মানদন্ড বলে বিবেচিত হলেও ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের প্রকৃত সফলতার মানদন্ড হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমেই কেবলমাত্র দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত সফলতা লাভ করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করে ইসলামী আদর্শের কর্মীরা। ইসলামী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা ইসলামী আদর্শের কর্মীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা ফরজ। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্রের কল্যাণ লাভ করে। একদল আদর্শিক কর্মী যদি আদর্শিক আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ হয় তাহলে তারা ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কাজ করে ক্ষমতাপ্রাপ্তির লোভে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এই প্রচেষ্টা। অব্যাহত প্রচেষ্টার পর যদি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা হয়ে যায়, আলহামদুলিল্লাহ! তা হবে খুব খুশির খবর। কিন্তু যদি ব্যক্তি হিসেবে যদি পরওয়ারদিগারের সন্তুষ্টি অর্জিত না হয় তাহলে ইসলামী আদর্শের কর্মী প্রকৃতভাবে সফল হয় না। ইসলামী আদর্শের কর্মীর চেষ্টার ফলে ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা না হলেও একজন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলেই প্রকৃত সফলতা অর্জিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা, অবয়বের দিকে তাকান না বরং তিনি তাকান তোমাদের মনের দিকে। (আল কুরআন) সুতরাং আমরা যারা আদর্শিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে কাজ করছি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় যদি সফল হয়ে যাই তা হবে বেজায় খুশির খবর আর আখেরাতের সফলতা যদি অর্জন করতে না পারি তা হবে প্রকৃত ব্যর্থতা। তাই আমাদের জীবনের চাকাটা সে পথেই পরিচালিত করা প্রয়োজন, যে পথে লৌকিকতা নেই, নেই আত্মতুষ্টি, যেখানে সব কাজের মূলে আল্লাহর সন্তুষ্টি।
দুনিয়া প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। পরীক্ষার কথা জেনেও যারা দিব্যি প্রস্তুতি না নিয়ে হেলায় খেলায় সময় ক্ষেপণ করে, দুনিয়ার জাহেলিয়াতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, তাদেরকে ইসলামী আদর্শের কর্মী বলা যায় না। যারা আল্লাহর গোলামি কাছে পৃথিবীর সকল চাওয়া পাওয়াকে উৎসর্গ করে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জানপ্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তাঁরই নির্দেশিত পথে চলতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে সেই মর্দে মুমিন, সেই ইসলামী আদর্শের জিন্দাদিল মুজাহিদ। তাঁর কাছেই দুনিয়া পদানত হয়, দুনিয়ার কাছে সে পদানত হয় না। তখন সে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় আর আল্লাহ হয়ে যান সেই বান্দার। আজ বড়ই প্রয়োজন সেই আদর্শিক কর্মী মূসা, খালিদ, তারিক, কাশিম, তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহর। যারা মরেও মরেনি। যাদের ঈমানী দীপ্ততায় এখনো তেজোদীপ্ত হয় লক্ষ কোটি তরুণ, খোঁজে ফেরে হেরার আলোক দ্যুতি। সেই আদর্শিক আলোয় উদীপ্ত আগামীর বিশ্ব। যে আদর্শ নিশ্চিত করবে বিশ্বমানবতার প্রকৃত কল্যাণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন