শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় উপকূলীয় শান্তিপূর্ণ বসতি এলাকা আলুথগামা। এলাকাটিতে মুসলমান ও বৌদ্ধরা বসবাস করেন। গত বছর এখানে বৌদ্ধদের হামলায় বহু মুসলমান হতাহত হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় তাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এমনই ভস্মীভূত নিজের বশ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় উপকূলীয় শান্তিপূর্ণ বসতি এলাকা আলুথগামা। এলাকাটিতে মুসলমান ও বৌদ্ধরা বসবাস করেন। গত বছর এখানে বৌদ্ধদের হামলায় বহু মুসলমান হতাহত হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় তাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
অহিংসানীতি বৌদ্ধ শিক্ষার মূল বিষয় হলেও শ্রীলঙ্কায় অনেক বৌদ্ধ ভিুর বিরুদ্ধে অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাতে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের অসহিষ্ণুতা ক্রমেই উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। কলম্বোর শহরতলির ছোট্ট একটি মঠ বা বৌদ্ধ মন্দির। মন্দিরটিতে সুমসাম নীরবতা। সাদা ও বেগুনি রঙের পদ্ম ফুল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বুদ্ধের একটি ছবি। দেয়ালে সারি সারি বুদ্ধের ছবি টাঙানো। কিন্তু ওপর তলায় গাঢ় কমলা রঙের পোশাক আবৃত একজন স্থুলকায় ভিু জানালেন, এই মন্দিরটি একটি কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনের প্রধান কার্যালয়। সিংহলি ভাষায় সংগঠনটির নাম বধূবালা সেনা, ইংরেজিতে বুদ্ধিস্ট পাওয়ার ফোর্স (বিবিএস)।
ভিু গালাগডা এথিথি গানানাসারা থিরো ধর্ম নিয়ে আলোচনায় ‘শান্তিপূর্ণ নিয়মকানুনের’ জন্য বৌদ্ধ ধর্মের একটি পরিচ্ছন্ন ইমেজ আছে বলে দাবি করেন। এখানকার বেশির ভাগ বৌদ্ধই জাতিগত সিংহলি। সিংহলিরা দ্বীপ দেশটির মোট জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগ।
গানানাসারা থিরো রাগত স্বরে বলেন, এই দেশটি কেবল সিংহলিদের, সিংহলিরাই এখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জনবসতি গড়ে তুলেছে। শেতাঙ্গরাই সব সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তার মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা শ্রীলঙ্কাকে ধ্বংস করেছিল এবং এখানকার বর্তমান সাংস্কৃতিক সমস্যাও বহিরাগতদের সৃষ্ট। বহিরাগত বলতে তিনি তামিল ও মুসলমানদের বুঝিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘুরা চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে ভারত থেকে এলেও মুসলমানেরাও সিংহলি, তাদের শেকড়ও সিহংলিদের মতোই কয়েক শ’ বছরের। গানানাসারা থিরো বলেন, আমরা দেশটিকে সিংহলিদের দেশে পরিণত করতে চাই। তা না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।
বৌদ্ধ ধর্মের এই চরম অসহিষ্ণু মনোভাব শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর বৌদ্ধ পুনর্জাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আনাগারিকা ধর্মপালা অসিংহলিদের প্রতি আরো বেশি বিদ্বেষপূর্ণ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, আর্য সিংহলিরা এই স্বর্গীয় দ্বীপ তৈরি করেছে, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকরা যা ধ্বংস করেছিল। মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি বলতেন, এই মাটির সন্তানদের নিঃশেষ করে দিয়ে তারা বিস্তার লাভ করেছে।
পরে ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী এসডব্লিউআরডি বন্দনায়েক একজন বৌদ্ধ ভিুর হাতে খুন হন। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি, তবে সরকার সিংহলি জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থÑ এমন অভিযোগ প্রচলিত ছিল তখন। এবং সেই ক্ষোভ থেকেই ওই ভিু প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করতে পারেন।
গত শনিবার বিবিসি রেডিও-৪ এ ‘বৌদ্ধ ধর্মের অন্ধকার দিক’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। তামিল জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলা সহিংস বিদ্রোহী গ্রুপ তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের ফলে বৌদ্ধ কট্টরপন্থী ধারণা ফের জাগ্রত হয়। এই লড়াইকে সিংহলি ও বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতিরোধের লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করে ২০০৪ সালে নয়জন ভিু জাতীয়তাবাদী দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় এটিই ছিল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মূল দল, পরে গানানাসরা থিরো সেটি ভেঙে বর্তমান দল বধূবালা সেনা (বিবিএস) গঠন করেন। একই ধরনের আদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এটি বর্তমানে এ ধারার মূল সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১২ সাল পর্যন্ত বিবিএস অন্যান্য সমজাতীয় সংগঠনের মতো সরাসরি হামলা-সহিংসতায় লিপ্ত হয়। তারা মুসলমানদের কসাইখানায় হামলা চালায়। তারা অভিযোগ করে যে, মুসলমানেরা পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করছে। এর সদস্যরা আরেকবার মুসলমানদের পক্ষে পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করার মিথ্যা অভিযোগে একটি আইন কলেজের সামনে বিক্ষোভ করে। যুদ্ধে তামিলরা পরাজিত হওয়ার পর মুসলমানেরা এখন এই বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। একই সাথে খ্রিষ্ট ধর্মীয় পাদ্রিরাও, তাদের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা ও ধূর্ততার সাহায্যে বৌদ্ধদের খ্রিষ্টান বানানোর অভিযোগ করা হচ্ছে।
বিএসবিকে কি সহিংস দল বলা যেতে পারে- এমন প্রশ্নে সংগঠনটির মুখপাত্র দিলানথা উইথানাজে বলেন, যখনই বৌদ্ধ ভিুরা ভুল কিছু করেছে, আমাদের জনপ্রিয়তার জন্য তার দায় আমাদের ওপর পড়েছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সমগ্র এশিয়াকে একটি মুসলিম রাজত্ব ঘোষণার হুমকির কথা উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, ‘বিএসবি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, এটি কারো বিপক্ষে সহিংসতা উসকে দেয় না; কিন্তু আমরা বিশেষ কিছু বিষয়ের বিরোধিতা করি।’
শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সামাজিক রক্ষণশীলতা বৃদ্ধিতে শুধু সিংহলিরাইয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে তা নয়। আগের চেয়ে নারীরা অনেক বেশি হিজাব ব্যবহার করছে। দেশের বিভিন্ন অংশে সৌদি আরবের প্রভাবিত ওয়াহাবি মুসলমানেরা আরো বেশি উদারতাবিমুখ। শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের মধ্যে কোনো ধরনের সহিংস মৌলবাদ থাকার প্রমাণ নেই। বরং তারাই বেশি অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। গত জুন মাসে ছোট্ট শহর আতালুঙ্গামায় বিবিএস ও অন্য বৌদ্ধ ভিুরা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানবিরোধী র্যালি করলে তা থেকে সৃষ্ট সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়। ওই সময়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ও দোকানে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাদের অনেকেই এখন অস্থায়ী উদ্বাস্তু হিসেবে বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।
অনেক উদার বৌদ্ধরাও কট্টর বৌদ্ধদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। গত বছর রেভ ভিজ্জিথা নামে এক বৌদ্ধ ব্যক্তিকে অপহরণ করার পর অজ্ঞান করে সুন্নতে খতনা করে দেয়া হয়। ওই ব্যক্তি মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে সহযেগিতার সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করেন বলে কট্টরপন্থী বৌদ্ধরা এই কাজ করেছে। বৌদ্ধ ভিুরা এর সাথে জড়িত বলে তিনি মনে করেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে আরেকটি ঘটনায়, ভিজ্জিথা মুসলমান সম্প্রদাযের অভিযোগগুলো তুলে ধরার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। বিবিএস সেই সম্মেলনে হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয়। গানানাসারা তাকে অপমান ও হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তুমি যদি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের সাথে জড়িত হও, তোমাকে তুলে নিয়ে মাহাওয়েলি নদীতে ছুড়ে ফেলা হবে।’
সম্প্রতি আরো একটি দেশের বৌদ্ধদের হিংস্রতা আলোচনায় এসেছে। মিয়ানমারে মুসলিমবিরোধী বৌদ্ধ সংগঠন ‘৯৬৯ আন্দোলন’-এর প্ররোচনায় বড় ধরনের সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। এই সংগঠনটির নেতা শিন উইরাথু সম্প্রতি বিবিএসের আমন্ত্রণে শ্রীলঙ্কায় যান। উভয় সংগঠন বলছে, যদিও তাদের নিজ নিজ দেশে বৌদ্ধ ধর্ম চালু আছে তথাপি তা হুমকির মুখে রয়েছে। বিবিএসের মুখপাত্র দিলতান উইথানেজ বলেন, ‘আমরা এটি প্রতিরোধ করতে চাই, অতএব আমরা দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া এবং জোট গঠনের একটি স্মারক সই করেছি’।
চলতি বছর শ্রীলঙ্কার জাতীয় নির্বাচনে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে মৈথ্রিপালা সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি বলেছেন, সবাই জানে যে বিবিএসের উত্থান করার সময়ে হয়েছে। পরোক্ষভাবে তিনি বিবিএসের উত্থানের জন্য তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্র রাজাপাকসের প্রশাসনকে দায়ী করেন। পূর্ববর্তী সরকার এই সংগঠনটির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল।
নতুন সরকারের বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী কারু জয়সুরিয়া মনে করেন, আইনের শাসন ভেঙে পড়ার কারণেই সংগঠনটি বিস্তার লাভ করেছে। তার সময়ে এই উগ্রবাদি সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে তিনি জানান। গত বুধবার গানানাসারা থিরোকে অনুমতি ছাড়া একটি বিক্ষোভ করার জন্য পুলিশ আটক করে। পরে অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পান। মনে হচ্ছে একটি শক্তিশালী বৌদ্ধ জাতিয়তাবাদী দল অন্তর্ভুক্ত বর্তমান সরকারও আগের সরকারের মতোই বৌদ্ধ ভিুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।
বৌদ্ধ ভিুর নিয়মকানুনে যেসব নৈতিকবিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল জীব হত্যা না করার প্রতিজ্ঞা। এবং অহিংসাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান মূলনীতি। তাহলে কেন ভিুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বাণী প্রচার করছে এবং এমন সব সমাবেশ করছে, যাতে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে?
বিবিসি অবলম্বনে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন